Save money make travel
বান্দরবান ! বাংলাদেশের একখন্ড স্বর্গ । যে স্বর্গের স্পর্শ পেতেই ভ্রমণপিয়াসীরা প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে এই স্বর্গরাজ্যে। ছুটে চলছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। দিগন্ত জুড়ে যে সীমান্ত শেষ সেখানেই মিলিত দূরের ঐ পাহাড়। তেমনি এক উষ্ণ আবহাওয়ায় "ইকোট্যুরিজম" ক্লাবের যাত্রা এই ভূস্বর্গের খোঁজে। উদ্দেশ্য ছিল খুমের জগতে হারিয়ে যাওয়া। খুম পাহাড়ি শব্দ যার অর্থই হল পাহাড়ের খাজ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি যেখানে জমাট থাকেই ওটাই""খুম"। আর এখানেই দেখা মিলবে আমিয়াকুম, নাফাকুম, ভেলাকুম আর নাইক্ষং এর মত অসাধারণ কিছু পাহাড়ি সৌন্দর্য।
ক্লাবের নিয়মিত ইভেন্টের মত এটি ছিল ১০২তম ইভেন্ট। যাত্রা শুরু বহদ্দারহাট টার্মিনাল হয়ে ১৫জন সদস্য নিয়ে বান্দরবানের পথে। রাত্রি যাপন হয় বান্দরবান শহরে। পরের দিন(২৪ই মার্চ) ভোরে যাত্রা ৭৮কিলোমিটার দূরে থানচির পথে। চান্দের গাড়ি নিয়ে এই ৭৮কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই পরবে শৈলপ্রপাত, চিম্বুক আর নীলগিরি। নীলগিরি পাড়ি দেওয়ার পর শুরু হয় রোমাঞ্চকর এডভেঞ্চার। জীবন নগরের ঢাল পাড়ি দিয়েই চ্যালেঞ্জিং যাত্রার প্রথম ধাপ শুরু হয়। একেবারে ৭০-৭৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে নামা পথটুকু সবাইকে কিছুটাও হলে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। থানচি পৌছনোর সাথে সাথে আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করা গাইড রেজাউল ওরফে মানিক ভাইকে নিয়ে বিজিবি এবং পুলিশকে রিপোর্টিং ও এন্ট্রি করে নিলাম। দুপুরের খাবার সেরে থানচি বোট ঘাটে নেমে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া নিয়ে যাত্রা শুরু সাঙ্গুর খরস্রোতা নদীর প্রতিকূলে। ৫জনের ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি নৌকা নিয়ে যাত্রা এখন পদ্ম মুখে। দুপাশে উচু পাহাড়ে থাকা পাহাড়ি আদিবাসী এবং তাদের পাড়ার সৌন্দর্য দেখে ৩০মিনিট পর পৌছালাম পদ্ম মুখে।
সূর্য তখন মাথার উপর খাড়া। এই তাপদাহ উষ্ণ আবহাওয়ায় শুরু এইবার ঝিড়ি পথে হাটা। হাটছি তো হাটছি! পনের জনের সারিবদ্ধ দল পদ্ম ঝিড়ি পাড়ি দিয়ে রুনাজন পাড়া এবং হরিশচন্দ্র পাড়া হয়ে ৫ ঘন্টা পাহাড়ি উচুনিচু বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে পৌছালাম থুইসা পাড়ায়। পরিকল্পনা মোতাবেক এখানেই প্রথম রাত কাটানোর কথা। পাড়ায় পৌছনোর আগে রেমাক্রী খালে কিছুক্ষণ লাফালাফি আর রিফ্রেশ হয়ে নিলাম। আগে থেকেই থুইসা পাড়ায় রাত কাটানোর জন্য মাচাং(আদিবাসীদের ঘর) ঠিক করে রাখলাম গাইড মানিকের মাধ্যমে। পাড়ায় পৌঁছে হালকা পাউরুটি, ডিম আর কলা খেয়ে হাত পা লম্বা করে যে যার মত করে নিজেকে শায়িত রাখলো। এই শায়িত অবস্থায় রাত ৯টা পাড় হয়ে গেল। সবাইকে ডেকে রাতের খাবারটা সেরে নিলাম। পাহাড়ি আদিবাসীদের হাতে বানানো আলুবর্তা ডিম ডাল দিয়েই প্রথম রাতের ভোজন হল। সবার মাঝে পরবর্তী দিনের পরিকল্পনা কি হবে হালকা ব্রিফিং দিয়ে প্রথম দিন সেখানেই সমাপ্তি হল। পরেরদিন ভোর হয় মেঘ আর পাহাড়ের যুদ্ধের সম্মুখীন হয়ে তবে এই যুদ্ধে পাহাড়ই জয়লাভ করে। মেঘের ভেলা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় ঐ পাহাড়ের পাদদেশে। যাত্রা শুরু এইবার দেবতার পাহাড় হয়ে খুমের জগতে। ২ঘন্টা হাটার পর যখন দেবতার পাহাড় পৌছালাম তারপর শুরু এই ট্রেইলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যাত্রা। নামতে হবে ৮০-৮৫ ডিগ্রি খাড়া পাহাড় বেয়ে সোজা ১৪০০ফুট নিচে। এই পথটাই ছিল এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চকর। ৩৫-৪০ মিনিট লাগলো এই পাহাড় ঘেষে নিচে নামতে। নামার পর বুঝতে বাকি রইলো না এইতো একখন্ড স্বর্গ।
দুপাশে খাড়া ১৪০০ফুট পাহাড়ি দেওয়াল আর তার মাঝে রেমাক্রী খালের এগিয়ে যাওয়া আর তার মাঝে হাতের বামপাশে অর্থাৎ ডাউনস্ট্রীমে নেমে গেল বাংলার নায়াগ্রাখ্যাত আমিয়াখুম আর ডান পাশ ধরেই এগোতেই পরে অসাধারণ এক খুম। আর খুমে ধরেই এগোতেই দেখা মিললো দু’পাশে বিশাল আকৃতির পাথরের পাহাড় আর তার মাঝে সবুজ, শান্ত, স্বচ্ছ জলধারা। হ্যাঁ এটাই নাইক্ষং। এবারে যাত্রা বাঁশের তৈরি ভেলা। তাই অনেকে "ভেলাখুম"ও বলেন! কিন্তু আসল ভেলাখুম যেতে আরো ৪৫মিনিট পাহাড়ি বুনো পথ হাটতে হবে।
যাই হোক মাত্র ১৫-২০ মিনিটের এই ভেলা বাওয়ার কাছে নস্যি দুনিয়ার সপ্তাশ্চর্যও! এই জল-গিরি পথ পাড়ি দেবার সময় বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন যে দু’পাশের আকাশছোঁয়া পাথরের পাহাড় দেবতার মতো গাম্ভীর্য নিয়ে আপনাকে আশীর্বাদ করছে। এই রুপ-সৌন্দর্যের বিবরন দিতে পৃথিবীর সকল উপমা ব্যবহার করলেও হয়তো এর সৌন্দর্য বর্ণনায় শব্দের কমতি হবে। শুধু বলবো এর সৌন্দর্য পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যকে ও হার মানাতে পারে। পাড়ি দিয়ে যখন পৌছালাম নাইক্ষং এর শেষ প্রান্তে বুঝতে বাকি রইলো না বিশাল আকৃতির বুনো পাথরের দল বহুবছর যাবত অপেক্ষা করে আসছে তার ভুবনে আমাদের স্বাগতম জানানোর জন্য।
এই বুনো পাথর ডিঙ্গিয়ে আমাদের যাত্রা আসল ভেলাখুমের উদ্দেশ্যে। ৩০-৪০মিনিট পর পৌছালাম ভেলাখুম। দুপাশে পাথরের পাহাড় আর তার মাঝে আকাবাকা হয়ে খুমের এগিয়ে যাওয়া এই যেন প্রাকৃতিক এক টানেল। পাথরের খাজ বেয়ে বেয়ে ভেলাখুমের শেষ প্রান্তে পৌঁছে স্বর্গ ছোয়া আরেকবার উপভোগ করলাম।
ঘন্টাখানেক এই সৌন্দর্যের মাঝে হাবুডুবু খেয়ে একই পথ ধরে ফিরে এলাম আমিয়াখুমে। আমিয়াখুমেরে শনশন জলধারার শব্দে হারিয়ে ফেলি নিজেদের। কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে ওখানেই বিশ্রাম নিয়ে নিল আবার কেউ কেউ এই জলধারায় নিজেকে আবদ্ধ রাখলো। আর ততক্ষণে আমরা দুজন(সাজিন ভাই এবং আমি) ভেলা নিয়ে ছুটে গেলাম সাত ভাই খুমের উদ্দেশ্যে। ৪০মিনিট ভেলা দিয়ে পাড়ি দেওয়ার পর পৌছালাম সাতভাই খুমের শেষ প্রান্তে । চারদিকে নিস্তব্ধ এক ভূতুড়ে পরিবেশ এই যেন ডাইনোসরের যুগে পদার্পন। তার পর যখন জানতে পারলাম সাতভাই খুমের নামের পিছনে সাতটি বিশাল পাথরকে কেন্দ্র করে একটুতো ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হবেই। তারপরও হেটে চলা ঐ সাতটি পাথরের খোঁজে। অবশেষে খুজে পেলাম এই সৌন্দর্য টুকু। একের পর এক বিশাল আকৃতির পাথরগুলো দাড়িয়ে আছে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে । দিশেহারা হয়ে এক পাথর থেকে অন্য পাথরে গা বেয়ে যখন উঠি তখনই ভাবতে থাকি আমি যদি ঐ রাজ্যের রাজা হতাম। কিন্তু এই রাজা হওয়ার ক্ষনিকের স্বপ্নটুকু সময়ের কাছে হার মানতে হয়। দলের অন্যান্য সদস্যরা হয়তোবা আমাদেরই অপেক্ষায় আছে। তাই ফিরে এলাম আমিয়াখুম, দেবতার পাহাড় হয়ে আবাসস্থল থুইসা পাড়ায়।
তখনই সন্ধ্যা নেমে এল। খাবার শেষ করে হালকা বিশ্রাম নিয়ে পাহাড়িদের মাচাং এর সামনে গানের আসর আর আড্ডায় মেতে উঠলাম বেশ কয়েকটি ভ্রমণপিয়াসী দলের সাথে। রাতভর গান, আড্ডা, বারবিকিউ আর ক্যাম্প ফায়ারিং এর মাঝেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল দ্বিতীয় রাত। খুব ভোরে ঘুম বিসর্জন দিই মেঘ দেখার আশায়। পাহাড়ের মাঝে মেঘের গ্রাস দেখে যাত্রা শুরু জিনাহ পাড়া হয়ে রেমাক্রীর দেখানো পথে। আর এই অনুসরণ করা পথই নিয়ে এল নাফাখুমে। অবশ্যই আমিয়াখুম দেখার পর নাফাখুমেরে সৌন্দর্য কিছুটা কমতি উপভোগ্য। এই যাত্রায় প্রথম দর্শন যদি নাফাখুম হতো তবে নিসন্দেহে ততক্ষণ পর্যন্ত নাফাখুমই সেরা হয়ে থাকতো। নাফাখুম গোসল সেরে যাত্রা রেমাক্রীর পথে। রেমাক্রী পৌছেই বোট ভাড়া করেই থানচির পথে রওনা। পথিমধ্যে তিন্দুর চোখ ধাধানো সৌন্দর্য উপভোগ করে থানচি পৌছালাম। অবশেষে থানচি হয়ে বান্দরবান আর তারপরই উপর আল্লাহর রহমতে রাত ১১টায় প্রিয় শহর চট্টগ্রাম পৌছালাম। সাধ্যের মধ্যে সবটুকু না পেলেও অনেক প্রাপ্তি ছিল এই ট্যুরে।
আরো ছবি দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের প্লান ছিল:
১ম দিন = বান্দরবান-থানচি -পদ্ম মুখ-পদ্ম ঝিড়ি -হরিশচন্দ্র পাড়া-থুইসা পাড়া(রাত্রি যাপন)
২য় দিন = থুইসা পাড়া -দেবতার পাহাড় - আমিয়াখুম -নাইক্ষং -ভেলাখুম -থুইসা পাড়া(রাত্রি যাপন)
৩য় দিন= থুইসা পাড়া -জিনাহ পাড়া -নাফাখুম -রেমাক্রি-তিন্দু-থানচি-বান্দরবান-চট্টগ্রাম।
TAGS: COXBAZAR, দ্বীপ থেকে দ্বীপে কুমের জগতে, থাইল্যান্ড ভ্রমণ
TAGS: COXBAZAR, দ্বীপ থেকে দ্বীপে কুমের জগতে, থাইল্যান্ড ভ্রমণ
1 Comments
As expected
ReplyDelete