নিয়ত ছিল সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে হাতিয়া যাব। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে লঞ্চ ছাড়া হল না। তাই নিয়তও পূর্ণ হলো না। যাত্রা শুরু তাই সড়ক পথে।
এ কে খান থেকে শাহী বাসে যাত্রা শুরু নোয়াখালী হয়ে চেয়ারম্যান ঘাটা পর্যন্ত। চেয়ারম্যান ঘাটা থেকে এইবার মেঘনার মোহনা পাড়ি দিয়ে পৌছালাম হাতিয়ার নলছিড়া ঘাটে। চট্টগ্রাম থেকে আসা লঞ্চটি এই নলছিড়া ঘাটেই থামতো। দুপুরের খাবার শেষ করে জীপে করে রওনা দিলাম মোক্তারিয়া ঘাটে। রাস্তা খারাপ হওয়ায় দেড় ঘন্টার পথ আড়াই ঘন্টা লাগলো এই ঘাটে পৌছাতে। নদী পাড় হয়ে নিঝুম দ্বীপে প্রবেশ করলাম। কিন্তু যেতে হবে নিঝুম দ্বীপের অপর প্রান্তে।  কনকন শীতে বাইকে করে ৩০মিনিট যাত্রা করে পৌছালাম নিঝুম দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত নামার বাজারে। তখনি সন্ধ্যা গড়িয়ে এল।
নিঝুম রিসোর্ট নামে কটেজটি আগেভাগে বুক না করার কারনে অন্য একটি রিসোর্ট নিতে হল। তবে থাকার জন্য রিসোর্টের অভাব হবেনা। এখানে বিভিন্ন ক্যাটাগরির রুম পাওয়া যায়, খরচও অনেক কম। হালকা বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বাজারে। গরম গরম জিলাপি আর ভাপা পিঠা শীতের আগমন বার্তা উপলব্ধি করা যায় এই বাজার ঘুরলে। সন্ধায় চায়ের পিরিচে আড্ডা আর লোকাল মানুষের কাছে নিঝুম দ্বীপের ইতিহাস জানা, তাদের পেশা,  জীবনযাপন এই নিয়ে আলোচনা করেই রাত ১১টা পাড় করে দিলাম।  তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হল চট্টগ্রাম থেকে আসছি বললেই তাদের আন্তরিকতা মাত্রাটা বেড়ে যায়। পরের দিনের প্লান করে নিলাম লোকাল এক নৌকার মাঝিকে নিয়ে। রাতেই খাবার শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমতো হল না, ঘুমের ভাণ নিয়ে শুয়ে পড়া। অবশ্যই নতুন কোন জায়গায় গেলে কৌতূহল বশত ঘুমও আসেনা। পরের দিন নৌকার মাঝিই ভোরেই ঘুম থেকে ডেকে দিল। নামার বাজার থেকে বোট নিয়ে কনকনে ঠান্ডায় চলে গেলাম চৌধুরী খাল হয়ে ম্যানগ্রোভ বনের গভীরে।

ছোট ইঞ্জিল চালিত বোট নেওয়ায় ভালো এক্ষেত্রে খালের ভেতরে ডুকতে কোন সমস্যা হবে না এবং খাল দিয়ে প্রবেশের সময় ইঞ্জিল বন্ধ করে যাওয়ায় ভাল।  যাতে করে নিঝুম দ্বীপের মূল আকর্ষণ মায়া হরিণের সাক্ষাত পাওয়া যায়।
বোট থেকে নেমে এইবার বনে প্রবেশ করার পালা। ঘন্টা দুয়েক এই বনে ঘুরলাম কিন্তু হরিনের দেখা পেলাম না। তবে মাটিতে হরিন পালের পায়ের চাপ, হরিনের মাথার খুলি আর পুরুষ হরিণের শিং পেয়ে বুঝতে বাকি রইলো না এটা হরিণের অভয়ারণ্য। এটা দেখেই তৃপ্তি নিয়ে চলে গেলাম নিঝুম দ্বীপের পাশ্ববর্তী আরেক চর।  নির্জন সেই চরে মহিষের পাল ছাড়া আর কোন আবাসস্থল নেই। ইচ্ছা ছিল মহিষের পিঠে চড়া, কিন্তু কাছেই গেলে মহিষগুলো ভয়ে পানিতে নেমে এলে সেটাও সম্ভব হয়নি।
এদিকে গ্রুপের কয়েকজনতো সিদ্ধান্তে অনড় যে হরিণ না দেখে তারা যাবে না। তাই আবারো বনের উদ্দেশ্যে রওনা তবে এইবার বনের অন্য প্রান্ত দিয়ে বনে প্রবেশ করলাম।  বনের ভিতর দিয়ে হেটেই গেলাম, শুধু পাখির কিচিরমিচির শব্দ ছাড়া বন্য কোন প্রানীর সাক্ষাত পায়নি। যদিও এই বনে হরিণ ছাড়াও বন্য কুকুরও রয়েছে যেগুলো হরিন হ্রাস পাওয়ার অন্যতম একটি কারন। নৌকার মাঝির ভাষ্যমতে  কুকুরগুলো অনেকসময় মানুষদের বনে প্রবেশ করতে দেয়না। সিদ্ধান্ত নিলাম এইবার না হেটেই কোন জায়গায় স্থীর হয়ে বসে থাকবো। হয় কুকুর না হয় হরিন যেকোন একটা দেখেই যাবো। অবশেষে ইচ্ছা পূরণের সময় এসে গেল। দূর থেকেই প্রথমে বুঝতে পারিনি, সামান্য টুকু আগাতেই টের পেয়ে বনে ভোঁ দৌড়। সেই দৌড়েই উধাও। এতেই তৃপ্তি। আর না এগিয়ে ব্যাক দিলাম লোকালয়ের পথে। বাজারে এসে  লাঞ্চ করে নিলাম। হাসের মাংস আর চিংড়ি দিয়েই দুপুরের খাবার যদিও তুলনামূলকভাবে দামটা অনেক কম। বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ডাব আর মহিষের দই দুটোর তৃপ্তি নিলাম। নিঝুম দ্বীপে গেলে ডাব না খেয়ে কখনো আসবেন না। কারনটা ডাবের পানি পান করলে বুঝতে পারবেন। জানেন কিনা জানি না বাংলাদেশে নোয়াখালি জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি নারিকেল সরবরাহ করা হয় যার মধ্যে হাতিয়া এবং নিঝুম দ্বীপের নারিকেল উল্লেখযোগ্য। সন্ধ্যা নামতেই রাতের জন্য প্রস্তুতি স্বরুপ যা যা দরকার নিয়ে নিলাম কারন আজ রাত কাটানো হবে বীচেই তাবু টাঙিয়ে। সূর্যাস্ত উপভোগ করে যখন সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার নেমে এলো তখনি তাবু সেট করে নিলাম। ঝালমুড়ি, পিঠা, জিলাপি আগেই নিয়ে এলাম। এখন খিচুড়ি রান্নার পালা। লোকাল এক পিচ্ছিকে নিয়ে ডেকসি আনিয়ে নিলাম। খিচুড়ির দায়িত্ব ছিল যৌথভাবে আশরাফ ভাই এবং সবুজ ভাইয়ের উপর যদিওবা বারবিকিউর দায়িত্ব আমার উপরই ছিল।



হাসের বাারবিকিউড়ি স্বাদটা কম হলেও খিচুড়ির স্বাদ ভূলে যাওয়ার মত নয়। পুরো রাত সুপার ফুল মুন আর সাগরের গর্জন নিতান্তই সঙ্গী হিসেবে পাশেই ছিল। এভাবেই পুরো রাতটাই কেটে যায়, শেষ রাতেই একটু ঘুম হলেও এটা ছিল ক্ষণস্থায়ী। সূর্যের আলো যখনি তাবু ভেদ করে চোখে পরে ঘুম আপনাআপনি পালিয়ে যায়। বীচে হেটেই পাওয়া গেল বিভিন্ন প্রকার মাছের পসরা যেগুলো সচরাচর আমরা দেখিনা। তবে এইবার বাড়ি যাওয়ার পালা। নাস্তা সেরে নোয়াখালির চেয়ারম্যান ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাস্তাঘাট খারাপ হওয়ায় যাত্রাটা এইবার বোটেই হবে। নিঝুম দ্বীপের পাড় ঘেসে হাতিয়া হয়ে ঘন্টা তিনেক পর পৌছালাম চেয়ারম্যান ঘাটা। সর্বোপরি চেয়ারম্যান ঘাটা থেকে প্রিয় চট্টগ্রাম।

কিভাবে যাবেন:
-চট্টগ্রাম থেকে চেয়ারম্যান ঘাটা (বাধন পরিবহণ, লোকাল ভাড়া ২২০টাকা)। শাহী বাস নোয়াখালী পর্যন্ত যাই, ভাড়া ২৮০, যদিওবা এটা ডাইরেক্ট সার্ভিস। ওখান থেকে সিএনজি করে চেয়ারম্যান ঘাটা। জনপ্রতি ১০০টাকা নিবে।
-চেয়ারম্যান ঘাটা থেকে স্পীড বোট(৪০০ টাকা), লঞ্চ(১২০টাকা) অথবা ট্রলার(১৫০টাকা) এই তিন উপায়ের যেকোনো একটিতে হাতিয়ার নলছিড়া ঘাটে যেতে হবে।
-নলছিরা ঘাট থেকে বাইকে(৫০০টাকা) অথবা লোকাল জীপে(১০০ টাকা) করে যেতে হবে মুক্তারিয়া বাজার ঘাটে।
-ছোট নদী পাড় হয়ে নিঝুম দ্বীপেই প্রবেশ করতে হবে। বোট ভাড়া ৪০টাকা নিবে।
-ওখান থেকে বাইক নিয়ে নামার বাজার। ভাড়া প্রতি বাইক ১০০-১২০টাকা নিবে। ওখানেই থাকতে হবে।

একই ভাবে ফিরে আসতে পারেন। অথবা নামার বাজার থেকে বোটে ডাইরেক্ট চেয়ারম্যান ঘাটা। ভাড়া ৩০০টাকা নিবে। ওখান থেকে চট্টগ্রাম বাঁধন পরিবহনে।


TAGS:  COXBAZAR,      দ্বীপ থেকে দ্বীপে   কুমের জগতে,  থাইল্যান্ড ভ্রমণ