আকর্ষণীয় এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের দেশ ভুটান। সুন্দর পাহাড় আর পরিপাটি শহর দেখে আপনার মন ভরে যেতে পারে। তাই কোনো এক ঝলমলে রোদে আপনি সড়কপথে বেরিয়ে পড়তে পারেন ভুটানের উদ্দেশে। ছবির মতো সুন্দর দেশ এই ভুটান। হিমালয়ের কোলে সুখী মানুষদের দেশ এটি। জনসংখ্যা অত্যান্ত কম। এর জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে সাত লাখ। ভূখণ্ড ৩৮ হাজার ৩৬৪ বর্গ কিলোমিটার। প্রধান ভাষা জঙ্ঘা। রাষ্ট্রধর্ম বৌদ্ধ। এ ছাড়া হিন্দু ধর্মও রয়েছে।

দারুণ সুন্দর পর্যটন অঞ্চল এবং মনোমুগ্ধকর সংস্কৃতিতে পূর্ণ দেশটি পর্যটকদের জন্য পছন্দের লিস্ট এর মধ্যে ঊর্ধ্ব থাকে। পর্যটনকে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে দিতে ভুটানে গড়ে উঠেছে অসংখ্যা উন্নতমানের হোটেল ও রির্সোট। ভুটান সরকারের রয়েছে আন্তরিক প্রচেষ্ঠা। এই ছোট্ট সবুজ পাহাড়ি দেশটি দেখার জন্য বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ প্রতিবছর ভুটান ভ্রমণ করে থাকে। আর এই ভুটানের সাথে আমাদের দেশের ইতিহাসের সাথে অনেক আগে থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশটি হলো এই ভূটান।

আমাদের বাংলাদেশ হতে সড়ক পথে এবং বিমান পথে এই দুই উপায়ে ভুটান যাওয়া যায়। বাংলাদেশীদের জন্য ভুটান যেতে কোন ভিসার প্রয়োজন হয় না। কিন্ত সড়ক পথে যেতে হলে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হয়। বিমান পথে গেলে খরচ একটু বেশি হলেও ভোগান্তি পড়তে হবে না। আর যদি সড়কপথে যান তাহলে আপনাকে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে যে ভিসার মেয়াদ থাকে সর্বোচ্চ ১৫ দিন। তবে আমি সাজেশন করব সড়ক পথে গেলেই আপনি অনেক কিছু করতে দেখতে পারবেন এবং শিখতে ও পারবেন। 

সড়ক পথে ভুটান ভ্রমনে খরচ অত্যান্ত কম। মনের মতো করে ভুটান দেখতে হলে সড়ক পথের কোন বিকল্প নাই। এইক্ষেত্রে ভারতীয় ট্রানজিট ভিসা পাওয়াটা একটু জটিল। তবে অসম্ভব নয়। ট্যুরিস্ট ভিসার মতোই কাগজপত্র দিতে হয়। ব্যতিক্রম শুধূ কনর্ফাম টিকেট ও ভুটানে হোটেল বুকিং। ভারতীয় ট্রানজিট ভিসা পাওয়ার পর আগের ঠিক করা তারিখে উঠে পড়ুন রংপুরের বুড়িমারীর উদ্দেশ্যে। আমরা রওনা দিই অন্য প্রান্ত চট্টগ্রাম থেকে সৌজা বুড়িমারী উদ্দেশ্য সন্ধ্যা পাঁচটার দিকে। চট্টগ্রাম থেকে শুধুমাত্র দুইটি গাড়ি যায় এই বুড়িমারী পর্যন্ত।একটি হল নাভিলা এবং আরেকটি হল তিস্তা। যেহেতু অন্য কোন অপশন নেই তাই আপনাকে এই দুইটার যেকোনো একটা হতে বেছে নিতে হবে। আর যদি আপনি ঢাকা হয়ে যেতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই ঢাকা যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে আপনার কিছু বাড়তি সময় চলে যাবে আমরা সেই সময়টুকু বাঁচিয়ে সন্ধ্যা পাঁচটায় বুড়িমারী উদ্দেশ্যে রওনা দিই এবং পরের দিন সকাল দশটার দিকে পৌঁছায় বুড়িমারী/চ্যাংড়াবান্ধা। ঢাকা আরামবাগ থেকে বাস ছাড়ে রাত ৮টায় এবং কল্যাণপুর থেকে ৯টায়। বাস বুড়িমারী সীমান্তে পৌঁছাতে সময় নেবে ১০ থেকে ১১ ঘন্টা। বুড়িমারী ইমিগ্রেশন অফিস খোলে সকাল ৯টায়। সকালের নাস্তা খেতে পারেন বুড়ির হোটেলে। বুড়িমারী/চ্যাংড়াবান্ধা বন্দরে ইমিগ্রেশন এবং ডিপার্চার কাজ শেষ হতে তেমন সময় লাগে না, তাঁরা ভালোই দ্রুত কাজ করেন। দুই পাশের ইমিগ্রেশনে কিছু বাড়তি টাকার প্রয়োজন হয়। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে ডলার/টাকা রুপিতে এক্সচেঞ্জ করে নিন (এখানেই ভালোরেট পাবেন)।

ইমিগ্রেশন আর ডলার এক্সচেঞ্জের কাজ শেষ করে  রওনা দিন জয়গাঁও ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিস (ভুটান সীমান্তের কাছে) উদ্দেশ্যে, ভাড়া পড়বে ১০০০-১৫০০ রুপির মত)। আর যদি লোকাল ট্রান্সপোর্ট করে যেতে চান তাহলে আপনাকে ময়নাগুরি নামক জায়গায় নেমে একটা লোকাল বাসে উঠে সোজা হাসিমারা। এখানে ভাড়া জনপ্রতি ৫০ রুপি। সেখান থেকেই অটোতে জয়গাঁও ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিস (ভুটান সীমান্তের কাছে) ভাড়া জনপ্রতি ১০ রুপি।

ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিস থেকে Departure/এক্সিট (সব ঠিক থাকলে সময় তেমন লাগে না) সিল লাগিয়ে সোজা ভুটান।

ভুটান ইমিগ্রেশন অফিস ফুন্টশোলিং-এ অবস্থিত জাস্ট ভুটান গেটের পাশেই, এখান থেকে on-arrival ভিসা নিতে হবে, এখান থেকে শুধু থিম্পু আর পারো-এর অনুমতি পাওয়া যাবে পুনাখা, হ্যাঁ ভ্যালী, বুমথাং ও অনন্য জায়গার অনুমতি পরে থিম্পু থেকে নিতে হবে আপনাকে, মনে রাখবেন ফুন্টশোলিং ইমিগ্রেশন অফিস শুধু মাত্র বাংলাদেশি আর বিদেশিদের জন্য সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে, কোনো সরকারি বন্ধ নেই। এখান থেকে চাইলে আপনি বাসে কিংবা জিপে করে রওনা দিতে পারেন রাজধানী থিম্পু কিংবা পারোর উদ্দেশ্যে। সময় লাগবে পাঁচ- ছয় ঘন্টার মত। চেষ্টা করবেন দিনের আলোতে রওনা দেওয়ার জন্য। এতে করে আপনি ভুটানের সৌন্দর্য, পরিবেশ সম্পর্কে অনেক কিছু উপভোগ করতে পারবেন। চাইলে সেদিন ফুন্টসোলিং থেকে যেতে পারেন।
 মোটামুটি কম খরচেই মিলবে ভালো হোটেল। এক রুম ১ থেকে দেড় হাজার টাকায় থাকতে পারবেন দুইজন। সময় বেশি না থাকলে সেদিন ফুন্টসোলিং না থেকে চলে যান পারো অথবা থিম্পুতে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শেষ বাস। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে পারো কিংবা থিম্পু যেতে পারেন, ভাড়া নিবে ২৫০ রুপী, সময় লাগবে ৬ ঘন্টা। তবে হাতে সময় থাকলে একদিন থেকে ছোট্ট শহর ফুন্টসোলিং ঘুরে দেখতে ভুলবেন না। সু
সাজানো গোছানো শহরের পাশ দিয়ে রয়েছে চলেছে নদী। কম খরচে পারো অথবা থিম্পু যেতে চাইলে বাসই ভরসা। সেক্ষেত্রে আগের দিন টিকিট করে রাখুন। ট্যাক্সি নিয়েও চলে যেতে পারেন। পারোতে থাকার খুব ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। পরের দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রওনা দিতে পারেন টাইগার্স নেস্ট ও পারো জং দেখতে।

পারো এয়ারপোর্টও মুগ্ধ করবে আপনাকে। পারো খুবই শান্ত ও আরামদায়ক একটি শহর। এই ছোট্ট শহর টি আপনার এতই ভালো লাগবে যে আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারি এমন পরিবেশ আগে কখনো আপনি উপভোগ করেননি।


দেখা শেষ হলে সন্ধ্যায় রওনা দিন থিম্পুর উদ্দেশ্যে। পারো থেকে থিম্পু যেতে দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে।  রাতটা কাটাবেন রাজধানী থিম্পুতে। হোটেল ভাড়াও ফন্টসিলিং এর মত নিবে। দুইজন থাকতে পারবেন হাজার টাকার মধ্যে। পরেরদিন খুব ভোরে উঠতে চেষ্টা করবেন। নাস্তা সেরে থিম্পু আশেপাশে বুদ্ধ পয়েন্ট, থিম্পু মনেস্ট্রি, রাজার বাড়ি দেখে রওনা দিন পুনাখার উদ্দেশ্যে। যদিওবা পুনাখা এবং ফোবজিকা ভ্যালি যেতে অনুমতি আগের দিন আপনাকে নিতে হবে কোন ট্রাভেল এজেন্সি কিংবা ড্রাইভার এর মাধ্যমে। যাওয়ার পথে দোচালা পাশে হিমেল হাওয়া আপনাকে স্বাগতম জানাবে তার ভুবনে। দোচালা পাস বা দোচুলা পাস (Dochula Pass) ভুটানের সব থেকে সুন্দর পাস। এটি রাজধানী থিম্পু থেকে পুনাখা শহরে যাবার পথে পরে। পাহাড়ী এলাকায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার সময় দুই স্থানের মাঝখানে সব থেকে উঁচু জায়গায় পাস বলে। দোচুলা পাস থিম্পু থেকে পুনাখা যাবার পথের সব থেকে উঁচু জায়গা যার উচ্চতা প্রায় ১০০০০+ ফিট। এই দোচালা থেকে নামার পরে পৌঁছাবেন পুনাখা শহরে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে তাই রাত কাটাবেন পুণাখা শহরে। বিভিন্ন ধরনের হোটেল এবং কিংবা রিসোর্ট পাবেন। ভাড়া পড়বে থিম্পু শহরের মত। রাতে আকাশটা একবার দেখবেন। পিন্টু এবং পুণাখার আকাশের মধ্যে আমি অনেক পার্থক্য দেখেছি। লক্ষ কোটি তারা রাতের আকাশে মিটমিট করে জ্বলছে। এই দৃশ্যটা এতটা মনমুগ্ধকর লেগেছে যে অর্ধেক রাত আমি বারান্দায় কেটে দিয়েছি প্রবল শীতের মধ্যে। তারপরও খুব ভোরে উঠতে আমার কষ্ট হয়নি কারণ কষ্টের কথা আমার মনে নেই উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র পুনা খা শহরটা ঘুরা। পতাকা জং এবং সাসপেনশন ব্রিজ অনেকটা সময় এখানে দিয়েছি তারপর চলে গেলাম এই মন্দিরে(Khamsum Yulley Namgyal Choeten)। এভাবেই এই দিনটা শেষ হয়। 



চাইলে একটি দিন বাড়তি যোগ করে ফোবোজিকা ভ্যালি ঘুরে আসতে পারেন। সময়ের স্বল্পতার কারণে হয়তোবা আমরা পারিনি তাই আমরা সোজা রওনা দিয়েছি ফুনট সেলিং বর্ডারের উদ্দেশ্যে। এই ফন্ট সেলিং/ জয়গাঁও বর্ডারে পৌঁছাই অনেক রাতে। এখানে রাত কাটিয়ে পরের দিন সকাল ১১ টার দিকে রওনা দিই বুড়িমারী বর্ডারের দিকে। ফুন্টসোলিং থেকে অবশ্যই ১২ টার মধ্যে বের হবার চেষ্টা করবেন। বের হবার সময় ঠিক আগের মতই সব ইমিগ্রেশন পয়েন্ট থেকে আপনার পাসপোর্টে এক্সিট সিল মারতে মারতে আসবেন একদম বুড়িমারি পর্যন্ত। অবশেষে বুড়িমারীতে সকল ধরনের ইমিগ্রেশন/ ডিপা র্টার সিল নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি এবং সন্ধ্যায় রওনা দিই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আল্লার রহমতে পরেরদিন ভোরে পৌছাই প্রিয় চট্টগ্রাম।




(ডিসেম্বরের দিকে ভুটান ভ্রমণের পরিকল্পনা থাকলে চেলালা পাস ও দোচালা পাস ঘুরে আসতে ভুলবেন না। ভাগ্য সহায় থাকলে এখানে পেয়ে যাবেন বরফ। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত বরফ পড়ে এখানে।)